কালো রঙের ধানের ছড়া। অথচ, সাদা রঙের চাল। সেই কবে কারা যেন যত্ন করে নাম দিয়েছিল, ‘কালোনুনিয়া’। ‘নুনিয়া’ বলতে এমনিতে কেউ বোঝান শাক, কেউ বা লতা। কিন্তু ধানকেও আদর করে ‘নুনিয়া’ নামে ডাকা গেল।
‘কালোনুনিয়া’ বিশেষভাবে তরাই আর ডুয়ার্সের ধান। লালমুখো ইংরেজরা যে-পথ দিয়ে বক্সাদুয়ার পেরিয়ে ভুটান হয়ে তিব্বত যেতে চেয়েছিল, সেই নদী-জঙ্গল-হাতি-বাঘ-ভাল্লুকে ভরা দেশের ধান। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারের নিজের ধান এই ‘কালোনুনিয়া’। আর এই ধান চাষ করেন কারা? রাভা, রাজবংশী, মেচ, নেপালি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাওরা। বাঙালিরাও অবশ্য করেন। এই ধানের গায়ে এসে লাগে ভুটানদেশের হাওয়া। দূরে আকাশের গায়ে ভাঁজ খেয়ে চেয়ে থাকে হিমালয়।
কালোনুনিয়ার চাষ সহজ নয়। এ ভারি স্পর্শকাতর ধান। মাটি ভালো না হলে ফলন জমে না। ফলন হয়ও কম। গড়পরতা অন্যান্য ধানের চাইতে অর্ধেক। কিন্তু, স্বাদে-গন্ধে এই ধানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিততে পারে খুব কম প্রজাতির ধান।কোচবিহারের বয়স্ক মানুষরা আজো গল্প করেন,গ্রামের কারো বাড়িতে কালো নুনিয়ার ভাত হলে গোটা গ্রামে থইথই করত গন্ধ। রাজা-প্রজায় কতই না তফাত। রাজশালে হাতি আছে, মোহর আছে। কিন্তু এই ধানের দৌলতে রাজা-প্রজার পাতে অন্নসাম্য ঘটত। কোচবিহারের রাজবংশের প্রিয় চাল এই কালোনুনিয়া। যে-চালের শরীরে প্রজাদের শ্রম আর যত্ন। যে চাল তখন হয়তো ফুটছে দূরের কোনো আদিবাসী প্রজার ঘরেও। রাজার পাতে যে ধন আছে, প্রজার পাতেও সেই একই ধন।
কালের নিয়মে বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে অনেক দেশি ধান।উচ্চ ফলনশীল ধানের গল্প মগজে চারিয়ে গেছে অনেকের। কালোনুনিয়াও লুপ্ত হতে বসেছিল।কিন্তু নানা চেষ্টায় সেই ভয়াবহ ক্ষতি আটকানো গেছে। আজো তাই তরাই-ডুয়ার্সের নানা প্রান্তে আদিবাসী মানুষরা এই ধানের চাষ করেন।এই বছরের গোড়ায় দেশের অন্যতম ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে এই চাল।জিআই তকমা জুটেছে। যে-তকমা পেতে গেলে ফসলের সঙ্গে জনজীবনের যোগসূত্রটিও খুঁজে বের করতে হয়,
প্রমাণ করতে হয় ফসলের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য।
সেইসব পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে কালোনুনিয়া। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ছাড়াও কালোনুনিয়া চাষ হচ্ছে চিলাপাতা, জলদাপাড়া অরণ্যের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বনগ্রামের জমিতেও। রাভা, মেচ, আদিবাসী মানুষরা বন-সংলগ্ন জমিতে চাষ করেন বাংলার এই সম্পদ। বন থেকে হাতি আসে, বাইসন আসে, গণ্ডার আসে। রাত জেগে পাহারা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয় ধান। তারপর, সেই শ্রম আর যত্নের ফসল অনেক পথ পেরিয়ে আসে কলকাতায়।
সেই সমস্ত বনগ্রাম থেকেই আমরা নিয়ে এসেছি বাংলার ধান-চালকুলের রাজপুত্তুর এই চাল। ‘ঢেঁকি’-র ভাণ্ডারে পাওয়া যাচ্ছে ‘কালোনুনিয়া’। সম্পূর্ণরূপে রাসায়নিক বিষমুক্ত। এই চাষ নিজ-নিয়মেই জৈব।
কালোনুনিয়া ফোটালে ঝরঝরে ভাত হয়। গন্ধে ভুরভুর করে চারপাশ। আবার, পায়েস-পোলাও-খিচুরিতেও এই চালের জুরি মেলা ভার। কথায় বলে, কালোনুনিয়া হেঁসেল আলো করে রাখে। কালোনুনিয়ার সেই আলো আপনাদের হেঁসেলেও পৌঁছক।